Loading...

Loading

Loading
(You are in the browser Reader mode)

১০ম অধ্যায়—খ্রীষ্টের পক্ষে প্রথম সাক্ষ্যমর

______________________________________« 

এই অধ্যায়টি প্রেরিত ৬৫—১৫; ৭ পদের উপর ভিত্তি করে রচিত 

______________________________________« 

সতাজন পরিচারকের মধ্যে প্রথম পরিচারক ছিলেন স্তিফান, যিনি তাঁর অনুপম সাধুতা ও নিখাদ বিশ্বাসের কারণের সুপরিচিত ছিলেন। জন্মসূত্রে যিহূদী হলেও তিনি গ্রীক ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং গ্রীকদের সমস্ত নিয়ম কানুন ও আচার অনুষ্ঠানের সাথে পরিচিত ছিলেন। এ কারণে তিনি গ্রীক ভাষাভাষী যিহূদীদের ধর্মধামে সুসমচার প্রচারের সুযোগটি নিয়েছিলেন। খ্রীষ্টের নাম ও তাঁর বিশ্বাসের বাণী প্রচারে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। বিজ্ঞ রাব্বিরা ও আইনজ্ঞরা তাঁর সাথে প্রকাশ্যে ধর্মীয় আলোচনায় লিপ্ত হতেন এবং তাঁকে সহজেই তর্কে পরাজিত করার কথা ভাবতেন। কিন্তু “তিনি যে বিজ্ঞতার ও যে আত্মার বলে কথা কহিতেছিলেন, তাঁহার প্রতিরোধ করিতে তাহাদের সাধ্য হইল না। “তিনি শুধু যে পবিত্র আত্মার শক্তিতে কথা বলতেন তাই নয়, বরং সেই সাথে তাঁর কথা শুনেই মনে হত যে তিনি ভবিষ্যদ্বানী বলা শিখেছেন এবং আইনের সমস্ত বিষয় তিনি জানেন। তিনি যে সত্যের বাণী প্রচার করতেন তার সপক্ষে সমস্ত যুক্তি উত্থাপন করতে ও তাঁর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তিনি সুসমর্থ ছিলেন। তাঁর মধ্য দিয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা পেয়েছিল, “অতএব মনে মনে স্থির করিও যে , কি উত্তর দিতে হইবে, তাঁহার নিমিত্ত আগ্রে চিন্তা করিবে না। কেননা আমি তোমাদিগকে এমন মুখ ও বিজ্ঞতা দিব যে, তোমরা বিপক্ষেরা কেহ প্রতিরোধ করিতে কি উত্তর দিতে পারিবে না। “লূক ২১:১৪, ১৫। AABen 77.1

যাজক ও শাসনকর্তারা তখন স্তিফানকে ক্ষমতা সহকারে প্রচার করতে দেখলেন, তখন তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা তৈরি হল। তিনি যে সাক্ষ প্রমান উপস্থাপন করেছিলেন তাতে বিশ্বাস করার বদলে তারা তাঁকে হত্যা করে তাঁর কন্ঠ রোধ করার চিন্তা করতে লাগল। বিভিন্ন সময় তারা রোমীয় কর্তৃপক্ষকে উৎকোচ দিয়েছিল যেন তারা স্তিফানকে তাদের হাতে তুলে দেয় এবং তারা যিহূদী মতে স্তিফানের বচার করে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারে। স্তিফানের শত্রুরা কখনো এ ব্যাপারে সন্দেহ করেনি যে, তারা নিজেদের জন্য কোন বিপদের আশঙ্কা না ঘটিয়েই এ ধরনের একটি কাজ করতে পারবে। তারা সব ধরনের বিপদের ঝুঁকি গ্রাহণের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং সে কারণে তারা স্তিফানকে বন্দী করে মহাসভার সামনে নিয়ে গেল। AABen 77.2

আশেপাশের সমস্ত দেশের বিজ্ঞ ও শিক্ষিত যিহূদীদেরকে বন্দীর জবানবন্দী খণ্ডন করার জন্য ডেকে পাঠানো হল। তার্ষ নগরীর শৌল সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই স্তিফানের বিরুদ্ধে মূল বাদী হিসেবে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত রব্বিদের মত রাগ্মিতা ও যুক্তিতর্ক দিয়ে এই মামলায় মূল বক্তা হিসেবে উপনীত হলেন এবং তিনি লোকদেরকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, স্তিফান অন্যন্ত ও বিপজ্জঙ্ক মতবাদ প্রচার করেছেন; কিন্তু স্তিফানের মধ্যে তিনি এমন একজন মানুষ দেখতে পেলেন তিনি ভিন্ন জাতির কাছে সুসমাচার প্রচারের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের লক্ষ সাধনে পরিপূর্ণ প্রত্যয়ী হয়ে রয়েছেন। AABen 78.1

যেহেতু যাজক ও শাসকেরা স্তিফানের সষ্ট ও শান্ত সমাহিত প্রজ্ঞার সাথে পেরে উঠছিলেন না , সে কারণে তারা তাঁর মধ্য দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চাইলেন; এবং এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তাদের প্রতিশোধের জ্বালা মিটবে, তেমনি অন্যরাও ভয়ে আর এই বিশ্বাস ধারণ করতে চাইবে না। এই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য মিথ্যা সাক্ষীদের ভাড়া করা হল যে, তারা স্তিফাঙ্কে ধর্ম্যাধামে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনেছে। “আমরা ইহাকে বলিতে শুনিয়াছি যে, সেই নাসরতীয় যীশু এই স্থান ভাঙ্গিয়া ফেলিবে, এবং মোশি আমাদের কাছে যে সকল নিয়ম—প্রণালী সমর্পণ করিয়াছেন, সেই সকল পরিবর্তন করিবে।” AABen 78.2

স্তিফান যখন বিচারকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই ঈশ্বর—বিরোধিতার অভিযোগের বিপক্ষে জবাব দিচ্ছিলেন, সে সময় তাঁর চেহারায় এক পবিত্র আলোকছ্বটা ফুটে উঠল, এবং “তখন যাহারা সভায় বসিয়াছিল, তাহারা সকলে তাঁহার প্রতি এক দৃষ্টে চাহিয়া দেখিল, তাঁহার মুখ স্বর্গদূতের মুখের তুল্য।” অনেকেই এই আলো দেখে ভয়ে কেপে উঠলেন এবং তাদের মুখ ঢেকে ফেললেন, কিন্তু তাতে করে শাসনকর্তাদের একগুঁয়েমি ও অবিশ্বাস বিন্দুমাত্র টলল না । AABen 78.3

স্তিফানকে যখন তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল তখন তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ় কন্ঠস্বরে কথা বলতে শুরু করলেন, যা পুরো মহাসভা কক্ষ জুড়ে গমগম করতে লাগল। এক কথায় তাঁর এই কথায় পুরো মহাসভা হতবাক হয়ে গেল। তিনি ঈশ্বরের মনোনীত জাতির ইতিহাস উল্লেখ করতে শুরু করলেন। তাঁর কথায় যিহূদীদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রকাশ পেল এবং খ্রীষ্টের আলোকে তিনি তার আত্মিক ব্যাখ্যা করলেন। মশীহ সম্পর্কে মোশী যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেটাই তিনি পুনরুক্তি করলেনঃ “ঈশ্বর তোমাদের জন্য তোমাদের ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে আমার সদৃশ এক জন ভাববীদকে উৎপন্ন করিবেন।” ঈশ্বরের প্রতি ও যিহূদী বিশ্বাসের প্রতি তাঁর বিশ্বাসকে তিনি সরলভাবে উপস্থাপন করলেন, আবার তিনি দেখালেন যিহূদীরা যে পরিত্রাণে বিশ্বাস করে তা ইস্রায়েল জাতিকে তাদের প্রতিমা পূজা থেকে বাঁচাতে পারেনি। তিনি যীশু খ্রীষ্টকে সমগ্র যিহূদী ইতিহাসের সাথে যুক্ত করলেন। তিনি রাজা শলোমন কর্তৃক মন্দির নির্মাণের কথা উল্লেখ করলেন এবং শলোমন ও যিশাইয় উভয়ের কথা অনুসারেঃ “তথাপি যিনি পরাৎপর, তিনি হস্তনির্মিত গৃহে বাস করেন না; যেমন ভাববাদী বলেন, “স্বর্গ আমার সিংহাসন, পৃথিবী আমার পাদপীঠ; প্রভু কহেন, তোমরা আমার জন্য কিরূপ গৃহ নির্মাণ করিবে? অথবা আমার বিশ্রাম—স্থান কোথায়? আমরই হস্ত কি এই সকল নির্মাণ করে নাই?” AABen 78.4

স্তিফান যখন এই পর্যায়ে আসলেন তখন লোকদের মধ্যে বেশ হইচই শুরু হল । তিনি যখন খ্রীষ্টকে ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে যুক্ত করলেন এবং যেভাবে তিনি ধর্মধাম সম্পর্কে কথা বলেছিলেন সেভাবেই কথা বললেন, তখন যাজকেরা প্রত্যেকে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং আক্রোশে ফুঁসছিলেন । এই দৃশ্য দেখে স্তিফান বুঝতে পারলেন তাঁর কন্ঠস্বর খুব দ্রুত নীরব করে দেওয়া হবে। তাঁর কথায় যে প্রতিবন্ধকতা আসছে তা তিনি বুঝতে পারলেন এবং তিনি এটাও বুঝতে পারছিলেন যে, এটাই তাঁর শেষ সাক্ষ্য দান। যদিও তিনি সে সময় প্রচারের মাঝামাঝি স্থানে ছিলেন, তিনি হঠাৎ করেই তা থামিয়ে দিলেন। AABen 79.1

ইতিহাসের যে ধারাপথে তিনি হাঁটছিলেন সেখান থেকে হঠাৎ করেই তিনি মুখ তুলে সামনে বসে থাকা ক্রোধোন্মাত্ত বিচারকদেরকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ “হে শক্তগ্রীবেরা এবং হৃদয়ে ও কর্ণে অচ্ছিন্নত্বকেরা, তোমরা সর্বদা পবিত্র আত্মার প্রতিরোধ করিয়া থাক; তোমাদের পিতৃপুরুষেরা যেমন, তোমরাও তেমনি। তোমাদের পিতৃপুরুষেরা কোন ভাববাদীকে তাড়না না করিয়াছে? তাহারা তাহাদিগকেই বধ করিয়াছিল, যাঁহারা পূর্বে সেই ধর্মময়ের আগমন জ্ঞাপন করিতেন , যাঁহাকে সম্প্রতি তোমরা শত্রুহস্তে সমর্পণ ও বধ করিয়াছ; তোমরাই দূতগণের দ্বারা আদিষ্ট্য ব্যবস্থা পাইয়াছিলে, কিন্তু পালণ কর নাই।” AABen 79.2

এই পর্যায়ে এসে যাজক ও শাসনকর্তারা তীব্র ক্রোধে পড়লেন। তারা সে সময় পশুর মত আচরণ করতে শুরু করলেন এবং দাঁতে দাঁত ঘষতে শুরু করলেন। তাদের নিষ্ঠুর চেহারা দেখে স্তিফান তাঁর পরিণতি বুঝতে পারলেন; কিন্তু তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তাঁর কাছে ক্রোধোন্মও যাজকেরা ও উত্তেজিত জনতা মোটেও আতঙ্কজনক ছিল না। তাঁর সামনের দৃশ্য ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করল। তাঁর জন্য স্বর্গের দ্বার খুলে দেওয়া হচ্ছিল। সেখান দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে তিনি ঈশ্বরের ও খ্রীষ্টের সিংহাসনের মহিমা দেখতে পেলেন, যেন তাঁরা তাঁদের পরিচর্যাকারীকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। বিজয়ীর কন্ঠে স্তিফান বলে উঠলেন, “দেখ, আমি দেখিতেছি, স্বর্গ খোলা রহিয়াছে, এবং মনুষ্যপুত্র ঈশ্বরের দক্ষিণে দাঁড়াইয়া আছেন।” AABen 80.1

দৃষ্টি সামনে মেলে দিয়ে স্তিফান এই পরাক্রমী দৃশ্যের বর্ণনা দিলেন তখন তাঁর বিচারকরা আর সহ্য করতে পারলেন না। তাঁরা নিজেদের কানে হাত দিলেন যেন এই কথা শুনতে না হয় এবং তীব্র চিৎকার করতে করতে তাঁরা এক সাথে স্তিফানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন “আর তাঁহাকে নগর হইতে বাহির করিয়া” নিয়ে গেলেন। “এদিকে তাহারা স্তিফানকে পাথর মারিতেছিল, আর তিনি হাঁটু পাতিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, প্রভু, ইহাদের বিপক্ষে এই পাপ ধরিও না। ইহা বলিয়া তিনি নিদ্রাগত হইলেন।” AABen 80.2

স্তিফানের সাক্ষ্যমর হওয়ার ঘটনাটি যারা দেখেছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের উপরেই তা গভির প্রভাব সৃষ্টি করেছিল । তাঁর চেহারায় ঈশ্বরের জ্যোতির চিহ্ন; তাঁর বাক্য , যা সেখানে উপস্থিত সকলকে স্পর্শ করেছিল এবং তাঁর প্রচারিত সত্য চিরকালের জন্য এই লোকদের স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু মণ্ডলীর জন্য ছিল এক তিক্ত পরীক্ষা, কিন্তু এর ফলে শৌলের মন পরিবর্তন হয়েছিল, যিনি তাঁর স্মৃতি থেকে সাক্ষ্যমর স্তিফানের বিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং তাঁর চেহারা ঐশ্বরিক প্রভার পরাক্রম কোনভাবেই ভুলতে পারছিলেন না। AABen 80.3

শটীফাণেড় বিচার ও মৃত্যুর দৃশ্যপটে বেশ প্রমত্ত ভঙ্গিতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তিনি মনে মনে এই ভেবে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে, স্তিফানকে যখন মানুষ চরমভাবে লাঞ্ছিত করছিল ঠিক সেই সময় তিনি ঈশ্বরের দ্বারা গৌরবান্বিত হচ্ছিলেন। শৌল ঈস্বরের মণ্ডলীকে ক্রমাগতভাবে নির্যাতন করতে লাগলেন, তাঁদের ঘরবাড়িতে লুটপাট চালাতে লাগলেন এবং তাদেরকে বন্দী করে হত্যা করার জন্য যাজক ও শাসনকর্তাদের হাতে তুলে দিতে লাগলেন। তাঁর এই চলমান অত্যাচার ও নির্যাতনের অভিযানের কারণে যিরূশালেমের খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। এই নিষ্ঠুরতা বন্ধের ব্যাপারে রোমীয় কর্তৃপক্ষ কোন বিশেষ উদ্যোগ তো নিলই না, উল্টো তাঁরা যিহূদীদেরকে এই অপকর্ম ঢাকার জন্য সাহায্য করতে লাগল। AABen 81.1

স্তিফানের মৃত্যুর পর উক্ত ঘটনায় বিশেষভাবে অবদান রাখার জন্য শৌল মহহাসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। কিছুদিনের জন্য তিনি শয়তানের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ঈশ্বরের সন্তান্দের বিপক্ষে অভিযান চালিয়ে গেলেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই এই অদম্য অত্যাচারী ব্যক্তিটি মণ্ডলী গঠনের কাজে ব্যাপৃত হলেন, যে মণ্ডলীকে তিনিই এখন নিজ হাতে খণ্ডবিখণ্ড করেছেন। শয়তানের চেয়েও শক্তিশালী একজন শৌলকে সাক্ষ্যমর স্তিফানের স্থানে নিযুক্ত করার জন্য মনোনীত করলেন, যেন তিনি তাঁর নামের পক্ষে প্রচার করেন ও কষ্টভোগ করেন এবং তাঁর রক্তের মধ্য দিয়ে পরিত্রাণ লাভের সুসমাচার যেন দূর দূরান্তে ছড়িয়ে যায়। AABen 81.2